ঢাকা,শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

অব্যবস্থাপনায় সাফারি পার্ক, সংশ্লিষ্টরা দায় এড়ায় কিভাবে ?

পলাশ বড়ুsafary parkয়া, সাফারি পার্ক থেকে ফিরে…

কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পুর্ব পার্শ্বে প্রায় নয়শ’ হেক্টর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক। পার্কটি দেশব্যাপী বেশ পরিচিত। কক্সবাজার জেলা শহর থেকে ৪৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থান পার্কটির। পরিবেশবান্ধব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কটি চিরসবুজ বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও বন্যপ্রাণির উন্নয়ন, ইকোটুরিজম ও চিত্তবিনোদনের সুযোগ সৃষ্টির জন্য ১৯৯৮-৯৯ সালে যাত্রা শুরু করে।

শনিবার (৪ ফেব্রুয়ারী) ননএমপিও ভুক্ত একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বনভোজনে অতিথি হিসেবে গেলে দেখা যায় নানান অসংগতি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার দর্শনার্থীদের প্রবেশ ফি: জনপ্রতি ২০টাকা, স্কুল প্রতিষ্ঠান হতে আগত ১৫ বৎসরের নিচে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ১০টাকা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আগত শিক্ষার্থী (৩০-১০০জনের গ্রুপ) এককালীন ২০০টাকা, ১০০জনের উর্ধ্বে ৪০০টাকা (শর্ত সাপেক্ষে), বিদেশীদের ৫ ইউএস ডলার উল্লেখ করা হলেও মানা হচ্ছে না এর কোনটি। টিকেট কাউন্টার, ইজারাদার, বিট কর্মকর্তার মাজহারের সাথে যোগাযোগ করেও ন্যায্য অধিকার বঞ্চিত হয়েছে খুঁদে শিক্ষার্থীরা।

অথচ বছর কয়েক আগেও এখানকার চিত্র ছিলো ভিন্ন। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে পর্যটকমুখর থাকতো এ পার্ক। বিশেষ দিনগুলোতে লাইনে দাঁড়িয়ে প্রবেশ করতো মানুষ। এখন আর সে দৃশ্য নেই। তবুও অল্প-স্বল্প যারা আসছেন তারা হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। কিন্তু কেন?

শনিবার সাফারি পার্কে প্রবেশ করতেই দেখা গেলো বিভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপের সাইনবোর্ড। তবে কচ্ছপের জন্য নির্ধারিত কাঁচের গ্লাসের সামনে গিয়ে সাইনবোর্ডে দেওয়া তথ্যের মিল পাওয়া যায়নি। অনেক প্রজাতির কচ্ছপের তথ্য দেওয়া থাকলেও বাস্তবে তার অস্থিত্ব মেলেনি।

সাইনবোর্ডে বলা হচ্ছে, শিলা কচ্ছপ, বড় কড়ি কাইট্টা কচ্ছপ, হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপ, সুন্দি কাছিম, কালি কাইট্টা রয়েছে। বাস্তবে এ প্রজাতির একটি কচ্ছপও পাওয়া যায়নি। অযতেœ মরে গেছে এসব কচ্ছপ। তবে বোস্তামী কাছিম, ডিবা কচ্ছপসহ এরকম দু’তিনটি প্রজাতির কচ্ছপ দেখা গেলেও এগুলোরও শেষ অবস্থা প্রায়ই! দেখারও যেন কেউ নেই!

আনন্দ আর অ্যাডভেঞ্চারের জন্য এ সাফারি পার্কে এলেও তা কারো কারো কালও হতে পারে। আসামি বানরের খাঁচার ভেতর থাকার কথা থাকলেও তা খাঁচার ছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে মানুষের ওপর হামলে পড়ছে। তখন দর্শনার্থীরা ভয়ে-আতঙ্কে মুঁচড়ে পড়ে। প্রায় প্রতিদিনই এমন দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানা গেলো।

সাফারি পার্কে দায়িত্বরত কয়েকজন জানালেন ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়ার ঘটনাও। ইতিপূর্বে সাফারি পার্কের বাঘশালা থেকে একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার খাঁচার ফটক খোলা পেয়ে বের হয়ে যায়। এ ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে পর্যটক ও স্থানীয়দের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করে। পরে অনেক কষ্টে বাঘটিকে খাঁচায় ঢুকানো হয়।

জানা গেলো, আগেও কর্মকর্তাদের দায়িত্ব অবহেলার কারণে এমন দুর্ঘটনা ঘটেছিল। এমনকি সাফারি পার্কটিতে বিগত সময়ে পৃথক ঘটনায় বাঘের হিংস্র থাবা থেকে দু’টি তরতাজা জীবনও রেহাই পায়নি। এ ঘটনা বড় উদাহরণ হয়ে আছে পার্কটিতে।

পার্কে আসা অনেকেই ভয়ে আতঙ্কে চলাচল করতে দেখা গেছে। পার্কটির সঠিক তত্ত্বাবধানে কেউ নেই। শনিবার সারা দিনেও সাফারি পার্কের বিট কর্মকর্তা মাজহারের দেখা মেলেনি। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ব্যস্ত আছেন বলে বিষয়টি এড়িয়ে যান।

পার্কের ভেতর দেখা যায়, কেউ কেউ খাঁচার ভেতর থাকা প্রাণীর দিকে ঢিল ছুঁড়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছেন।

উখিয়া রুমখাঁ পালং উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরুল আমিন বলেন, নিয়মনীতি কোন বালাই নেই। শিক্ষার্থীদের যে মূল্য তালিকা দেওয়া হয়েছে তার কোনটি মানা হচ্ছে না। মাধ্যমিক বিদ্যালয় পড়–য়া কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেও ২০টাকা করে হাতিয়ে নিচ্ছে। তাছাড়া পার্কের ভিতরেও বাঘ, সিংহ, কুমিরের মতো কাচার রেলিং বা গ্রীল গুলি দীর্ঘদিন সংস্কার করা হচ্ছে না। ফলে যে কোন মুহুর্তে বড় ধরণের দুর্ঘটনার ঘটে যেতে পারে। ঘুরে নানা অনিয়মই চোখে পড়লো। কোনো গাইড নেই। ভীতিকর কিছু জায়গায় লোকজন থাকা উচিত। কাউকে দেখা গেলো না। এছাড়া পার্কজুড়ে ময়লা আবর্জনা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে রক্ষিত প্রাণীর মধ্যে রয়েছে বাঘ, সিংহ, হাতি, মায়া হরিণ, প্যারা হরিণ, বন্য শূকর, খরগোশ, হনুমান, বাঁশ ভালুক, বনগরু বা গয়াল, বাঘডাস, বনবিড়াল, মার্বেল বিড়াল, চিতা বিড়াল, সজারু, বাদুর, লজ্জাবতী বানর, আসামি বানর, উল্লুক, কালো ভালুক, সাম্বার, শিয়াল, মেছো বাঘ, জলহস্তীসহ আরও কিছু প্রজাতির পশু-পাখি। ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ, ঠিকসময়ে খাবার না দেওয়া এবং পরিচর্যার অভাবে এ সাফারি পার্কে পশু-পাখির সংখ্যা কমছে।

পুরো পার্কে দায়িত্বরতদের অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনা ছিলো লক্ষণীয়। দুপুরে দেখা যায়, বন্দি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের খাঁচায় দু’জন কিশোর ঢিল ছুড়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে। পরে আরেক দর্শনার্থীর অনুরোধে তারা ঢিল ছোড়া বন্ধ করে। বাঘের খাঁচার দায়িত্বেও তখন কাউকে দেখা যায়নি।

নানা কারণে পার্কটির গুরুত্ব থাকলেও অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনায় চলছে ডুলাহাজরা সাফারি পার্কটি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত এক বছরে কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে পার্কটিতে।

জানা যায়, এক সময় গগনচুম্বী গর্জন, বৈলাম, তেলসুর, সিভিট, চাপালিশ, চম্পা ফুল, লতা-গুল্মরাজির চিরসবুজ এ বনাঞ্চলে দেখা মিলতো হাতি, বাঘ, হরিণ, ভল্লুক, বানরসহ অসংখ্য প্রজাতির। কিন্তু অনিয়ম, অযতœ, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে এবং অবৈধ শিকারের ফলে এ বনাঞ্চলের অসংখ্য বন্যপ্রাণি প্রকৃতি থেকে বিলুপ্তির পথে।

কুমির বেষ্টনীতে স্থাপন করা হয়েছে ওয়াচ স্টেজ। যা সংস্কার অভাবে দুর্বল হয়ে গেছে। বিচরণরত পশুপাখির জন্য তৈরি করা হয়েছে এনিম্যাল ফিডিং স্পট। এছাড়া পাখিশালা নির্মাণ, বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় এশীয় ও আফ্রিকান গুরুত্বপূর্ণ বন্যপ্রাণিও সংগ্রহ করা হয়েছে।

তৈরি করা হয়েছে পর্যটন টাওয়ার। ৬০ হেক্টর বনাঞ্চল নিয়ে বাঘ, ৪০ হেক্টর বনাঞ্চল নিয়ে সিংহ, ৫০ হেক্টর বনাঞ্চল নিয়ে সাম্বার, মায়া হরিণ, চিত্রা হরিণ, গয়াল ও অন্যান্য তৃণভোজী প্রাণীর জন্য বেষ্টনীও তৈরি করা হয়েছে।

এছাড়াও রয়েছে বন্যপ্রাণির জন্য ৫০ হেক্টর এলাকা নিয়ে আটটি জলাধার, ২০ হেক্টর এলাকা নিয়ে ভল্লুকের বেষ্টনী, ১০ হেক্টর এলাকা নিয়ে কুমিরের বেষ্টনী, ৫ হেক্টর বনাঞ্চল নিয়ে জলহস্তীর বেষ্টনী এবং ১৫০ হেক্টর বনাঞ্চল নিয়ে হাতির বেষ্টনী। এতো কিছু করা হলেও নেই সঠিক পর্যবেক্ষণ।

এখানে পর্যটকদের জন্য বন্যপ্রাণি দর্শনে রয়েছে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। তবে সে টাওয়ারে ওঠার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। সিঁড়িতে গাছের কাঠ দিয়ে প্রতিবন্ধকতা করে রাখা হয়েছে।

রিমা বড়–য়া নামে এক পর্যটক পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের সামনে এসে বলেন, এটা করে লাভ কী হলো, যদি ওঠার পথে প্রতিবন্ধকতা দিয়ে রাখা হয়। দায়িত্বরত কাউকে না দেখে তিনি ক্ষোভও প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, এখানে বেশ কিছু রিস্কি জায়গা আছে, যেগুলো পর্যটকদের জন্য বিপজ্জনক। তাই গাইড বা সহায়ক থাকা প্রয়োজন।

সাফারি পার্কটিতে আসা পর্যটকরা জানান, এতোবড় পার্কে চলার জন্য গাইড নেই। কারও সহযোগিতা নিয়ে চলারও উপায় নেই।

পার্কের দুরাবস্থার কথা জানতে চেয়ে ২০১৬-২০১৭অর্থ সনের ইজারাদার মো: নাছিরের সাথে একাধিক বার চেষ্টা করেও সংযোগ না পাওয়ায় তার বক্তব্য সম্ভব হয়নি। টিকেট কাউন্টারের দায়িত্বরত একজন বলেন, এবার ৬০ লক্ষ টাকায় ইজারা নেয় মো: নাছির। পার্কের নানান অসঙ্গতির কথা বলতে গেলে তিনি কৌশলে তার নাম না বলার শর্তে স্থানীয়দের সুবিধা বঞ্চিত করার কারণে এসব হচ্ছে বলে তিনি জানান। তাছাড়াও ফরেষ্ট ডিপার্টমেন্টের দায়িত্বশীলদের দুষলেন কৌশলে।

পাঠকের মতামত: